Thursday, September 23, 2010

সোঁদা মাটির গন্ধ

ভেতরে কেবল শূন্যতা বাড়ছে। আসার সময় যতোই ঘনিয়ে আসছে নাড়ি ছেঁড়ার ঘন্টা বাজছে বুকে। সোঁদা মাটির গন্ধটা আরও তীব্র হচ্ছে নাকে। চারদিকের বাতাসে শুধুই শূন্যতার হাহাকার। গ্রাম থেকে নিকট আত্মীয়স্বজন এসে দেখা করে যাচ্ছে। বাসার ভেতর সবসময় গুমোট ভাব। বোনদের কান্না, ভাইদের চোখের করুণ চাহনি সময়টাকে আরও দুঃসহ করে দিচ্ছে।

কাছের বন্ধুবান্ধবদের থেকে ফোনে পাচ্ছি বিদায়ী শুভেচ্ছা। অনাগত প্রবাস জীবনের বাস্তব চিন্তায় মনের ভেতর এক দুঃসহ জ্বালা এসে ভর করছে। বাসার এ পরিস্থিতিতে কারও সাথে দেখা করার জায়গাও বদলে ফেলেছি। বন্ধুদের কাউকে বলি না আর বাসায় আসতে। ছুটে যাই ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে। আড্ডা দেই কাছের বন্ধুদের সাথে।

গানের আড্ডার লোকজনেরও মন খারাপ। শিল্পী-সুরকারগণ তাদের প্রিয় গীতিকারকে হারাচ্ছেন। প্রিয় এজন্যই যে যখন তখন ডাকলেই পেতেন আমাকে। লিখে নিতে পারতেন তাদের পছন্দের বিষয়ের গান। আর আড্ডাটাও দারুণ উপভোগ করতাম আমি। সন্ধ্যা হলেই ছুটে যেতাম মৌচাক-মগবাজারের স্টুডিও পাড়াতে। সৃষ্টি হতো নতুন কিছু গান। সুরকার-সঙ্গীতপরিচালকগণ যত্ব করে বাসাতেন সুর-মিউজিক। সেগুলো রেকর্ড করে শিল্পীরা গাইতেন বিটিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলে।

স্বনামধন্য সুরকার, সঙ্গীতপরিচালক বদরুল আলম বকুল ভাইয়ের নেতৃত্বে শিল্পী মখলেছুল ইসলাম নীলু, মুজিবুল হক সেন্টু, হুমায়ুন কবির ও তান রেকর্ডিং স্টুডিওর কর্ণধার পিয়ালরা মিলে আয়োজন করলেন আমার জন্য বিদায়ী আড্ডা। স্থানীয় চাইনিজ রেস্তোয়ায় খাওয়াদাওয়ার পর পেলাম সুন্দর কিছু গিফট। সবাই মিলে আমার জন্য একটা সুন্দর পাঞ্জাবী কিনে এনেছেন। শিল্পী মখলেছুল ইসলাম নীলু ও শামীমা সুলতানা আমার লেখা তাদের গাওয়া গানগুলো সিডিতে সাজিয়ে এনে তুলে দিলেন হাতে। আধ আলো আধ অন্ধকারে তাদের মুখগুলো দেখে বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো। একদিন এ আড্ডায় আর থাকবো না আমি!

ওদিকে পরের দিন শাহবাগকেন্দ্রিক লিখিয়ে বন্ধুরা আয়োজন করলেন আরেকটি বিদায়ী আড্ডা। এবারের বইমেলার পর এটাই ছিলো আমার জন্য সবচেয়ে বড়ো আড্ডার আয়োজন। শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের নেতৃত্বে এলেন মাহবুব লীলেন, আকতার আহমেদ, মৃদুল আহমেদ, আবু রেজা, ষষ্ঠপাণ্ডব, সবজান্তা, তারেক,  এনকিদু, অনার্য সঙ্গীত, দুষ্টু বালিকা, সুরঞ্জনা, ঐন্দ্রিলা, অভ্রর মেহেদীসহ অনেক সচল বন্ধুরা। শেষবারের মতোন দেখে নিলেন তাদের জায়গীর ভাইয়ের মুখচ্ছবি। লেখা সংরক্ষণের ব্যাপারে মাহবুব লীলেন অনেক মূল্যবান পরামর্শ দিলেন। সেদিনকার আড্ডাতে লিখিয়ে বন্ধুদের বিস্তর সময় থাকলেও লাগেজ গোছানোর তাড়ায় ওখান থেকে বিদায় নিতে হলো আমাকে। পিছে রেখে এলাম একরাশ ভালোবাসায় সিক্ত তাদের সুন্দর মুখগুলো।

এদিকে লেকের পাড়ের আড্ডাতেও বাজছে বিদায়ী ঘন্টা। প্রতিদিনকার আড্ডার সাথী আবু রেজার অবয়বেও ফুটে উঠছে হতাশা আর বন্ধু হারানোর ব্যথা। সময় করে প্রিয় ছড়াকার আকতার আহমেদও একদিন শেষ আড্ডা দিয়ে গেলেন আমার সাথে। কলাবাগানের পড়শি চেয়ারম্যান হাবিব সাহেব এ্রখন বেশি বেশি সময় দিচ্ছেন আমাকে। বাসায় ফিরতে বাসা থেকে বেরুতে ঘন ঘন দেখা হচ্ছে তার সাথে। ছোট্টবেলার বন্ধু জুলহাস শেষ বিদায় নিয়ে চলে গেলো নতুন কর্মস্থল রাজবাড়িতে। চায়ের দোকানের হান্নানের কথাবার্তার মাঝেও বিদায়ী সুর। প্রতিদিন চা খেতে খেতে যাদের সাথে আলাপ পরিচয় ছিলো তাদের মাঝেও ফুটে উঠছে দুঃখবোধ। প্রিয় আড্ডা ছেড়ে যাচ্ছি সুদূর কানাডাতে- এ যেন ভাই হারানোর বেদনার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

একে একে সব আসবাবপত্র নিয়ে গেলো সবাই। কেউ নগদ দামে, কেউ বা বিনামূল্যে। চোখের সামনে সাজানো ঘরবাড়ি শূন্য হয়ে গেলো। বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো। এ বাসাতেই ছিলাম দীর্ঘ সাত সাতটি বছর। কতো স্মৃতিই না জড়িয়ে আছে এখানকার প্রতিটি রুম, সিঁড়ি, দালানের ইট-পলেস্তারায়! শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়োয় হারিয়ে গেলো অদেখা মূল্যবান কাগজপত্র, লেখালেখির কিছু পাণ্ডুলিপি, গানের সিডি, ক্যাসেট আর প্রিয় ভিডিওগুলো। কোনো নিকট আত্মীয়স্বজন নিজের মনে করে নিয়ে গেছে অথবা নেয়নি- হারিয়ে গেছে চিরতরে।

আমাদের ফ্লাইট ছিলো ৩০ এপ্রিল ভোর ৪.০৫টার সময়। ২৯ তারিখ রাত ১২টার মধ্যেই এয়ারপোর্টের উদ্দেশে বের হতে হবে আমাদের। এতোদিনের আপন বাসা ছেড়ে দুপুরে চলে গেলাম রাস্তার উল্টো পাড়ে পশ্চিম রাজাবাজারে শ্বাশুড়ির বাসায়। ভাগ্নে টিটু, শ্যালক বাবলু অনেক কষ্টে লাগেজগুলো শেষবারের মতোন পরখ করে ভালোভাবে বেঁধে পাসপোর্ট নম্বর, নাম-ঠিকানা লিখে দিলো। শ্বাশুড়ির বাসা ভর্তি লোকজন, আমাদের শেষ বিদায় জানাতে এসেছেন। তিন জ্যাঠাইশ, দুই ভায়রা, বড়ো ভাই শেখ জয়েন উদ্দিনসহ ভাগ্নে-ভাগ্নিরা।

রাত বাড়ছে, বাড়ছে টেনশনও। বাইরে গাড়ি প্রস্তুত। শ্যালক বাবলু অফিসে বলে রেখেছিলো। ভাগ্নী জামাই প্রস্তুত রেখেছেন তার নিজস্ব র‌্যাবের গাড়ি। ফোন পাচ্ছি প্রচুর। শেষ মুহূর্তে আবারও ফোন করলেন বন্ধুবর আবু রেজা, জুলহাস উদ্দিন, ডা. আলী, আহমেদুর রশীদ টুটুল ও সুরকার বদরুল আলম বকুল ভাই। ছোট্টবেলার বন্ধু মংলার  ফোন আসছে একটু পরপরই- এয়ারপোর্টে অসুবিধা হলে তাকে যেন ফোন করি, কীভাবে  ইমিগ্রেশন পেরোবো ইত্যাদি।

সবারই চোখমুখ ভারি। তবে শ্বাশুড়ির কান্না যেন আর থামছে না। কাছাকাছি বাসা থাকার কারণে তাঁর ছোট মেয়ে মানে আমার স্ত্রী তাকে দেখাশোনা করতো বেশি। সারাক্ষণ উনি সেই কথাই বলছেন আর চোখের পানি ফেলছেন- কে তাকে দেখবেন, কে এমন করে খোঁজ-খবর নেবেন? ছোট বড়ো সবার চোখে কম বেশি পানির ঢল নামছে। জেঠাইশ রেজওয়ানা বুলবুল, শ্যালক বাবলু ও তার স্ত্রী-মেয়েসহ সবাই উঠলাম গাড়িতে। এবার এয়ারপোর্ট যাবার পালা।

বাসা থেকে বেরুতে ১২টার বেশি বেজে গেলো। শ্বাশুড়ির কান্নায় মা'র স্মৃতি ভেসে উঠলো মনে। আজ মা বেঁচে থাকলে এরকম কান্নায় তিনিও অস্থির হতেন, আল্লাহর কাছে সন্তানের শুভযাত্রা কামনা করে দু'রাকাত নফল নামাজ পড়তেন। আমার এ জীবন গড়ার প্রথম কারিগর সবচেয়ে বড় ভাই অধ্যক্ষ শেখ জহির উদ্দিনও আজ নেই। তিনি থাকলে হয়তো হাজারও ফোন পেতাম গ্রাম থেকে। মূল্যবান নানান পরামর্শ দিয়ে আমার এ প্রবাস যাত্রার মঙ্গল কামনা করতেন তিনি। আজ সে অভাব কিছুটা পূরণ করছেন প্রিয় ভাই শেখ জয়েন উদ্দিন। আমাদের আগেই তিনি চলে গেছেন এয়ারপোর্টে। অপেক্ষা করছেন শেষ বিদায়ের জন্য।

সারা রাস্তা পিনপতন নীরবতাতে কাটলো আমাদের। সাথে আসা জেঠাইশ রেজওয়ানা বুলবুল আপা ও শ্যালক বাবলুও তেমন কথা বলেনি। এবার বিদায়ের পালা এয়ারপোর্ট গেটে। আর একবার কান্নার রোল পড়ে গেলো আমার স্ত্রী ও ভাইবোনদের মাঝে। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে তাদেরকে বিদায় জানিয়ে লাগেজ নিয়ে ঢুকে গেলাম ভেতরে। বড় ভাই শেখ জয়েন উদ্দিন গেলেন না, টিকেট কেটে ভেতরে চলে এলেন আমাদের সাথে। জীবনের সংগ্রামবহুল দিনগুলোতে এ ভাইটি আমার কেমন করে জানি সবসময় পাশে থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমাকে একা ছাড়তে তার মন সায় দিচ্ছিলো না তখন।

রাত প্রায় ২টা রেজে গেছে। ভাইয়ের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেলাম চেক ইনে। আমাদেও সামনের ভদ্রলোকও সপরিবারে যাচ্ছেন দেশের বাইরে। তার লাগেজগুলোর ওজন বেশি হওয়াতে এক্সট্রা ডলার গুণতে হলো তাকে। আমার মনেও তখন ভয় ভয় ভাব। কারণ আমার আনা লাগেজগুলোর মধ্যে দুটো কার্টনের ওজন ছিলো বেশি। কিন্তু ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হলো। সামনের ভদ্রলোকের সময় বেশি লাগছে দেখে ঐ অফিসার আমাকে ইশারা করলেন পাশের কাউন্টারে যেতে। এক এক করে ৮ টা লাগেজ উঠিয়ে দিলাম ওজন মেশিনে। শরীরে এতো শক্তি পেলাম কোথা থেকে বুঝতে পারলাম না। কারণ বাসায় ঐ লাগেজগুলোই একা আমার পক্ষে উঠানো কষ্টকর ছিলো। অফিসার ভদ্রমহিলা কার্টন দুটোর ওজন করার সময় কপাল কুঁচকালেন। কী মনে করে আবার ছেড়ে দিলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

এবার ইমিগ্রেশনের পালা। আরও একটু ভেতরে চলে গেলাম ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। কাঁচঘেরা বাউন্ডারির ওপারে ভাই আমাদের চোখের আড়াল হচ্ছেন না। রেলিং ধরে তাকিয়ে আছেন আমাদের কাউন্টারের দিকে। এখানে এসেও সামনের এক ভদ্রলোকের জন্য সময় ক্ষেপণে আমাদের দেরি হচ্ছে। তার বিদেশি পাসপোর্টে বাংলাদেশে অবস্থানের মেয়াদ নিয়ে ঝামেলা। ইমিগ্রেশন অফিসার তার উর্ধতনের সাথে বুঝে ব্যবস্থা নিতে চাচ্ছেন। এক সময় কাউন্টার থেকে তাকে পাঠিয়ে দিলেন অন্যখানে। বাঙালি এ অফিসারের কম্পিউটার ব্যবহারের শ্লথগতি অপেক্ষার সময়টাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের ৪ জনের পাসপোর্ট-ভিসা পরখ করে তার কম্পিউটারের ওয়েবক্যামে ছবি তুলে তথ্য সংরক্ষণ করতে করতে চলে গেলো ঘন্টা দেড়েক। রেলিং-এর ওপাশে বড়ো ভাই শেখ জয়েন উদ্দিন তখনও দাঁড়িয়ে।

কাতারগামী আমাদের ফ্লাইটের বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে। আমরা দোহা-হিথরো হয়ে এয়ার কানাডার ফ্লাইট ধরে এডমন্টন শহরে যাবো। এতো লম্বা ভ্রমণের আশংকায় আমার সিগারেটের তৃষ্ণা বোধ হয় একটু বেড়ে গেলো। বউ-ছেলে-মেয়ে টয়লেট যাবার সুযোগে আমি স্মোকিং কর্ণার খুঁজে ধূমপানের পর্বটা সেরে নিলাম। বন্ধু মংলা তখনও জেগে আছে বাসায়। মোবাইলে আমাকে ফোন দিচ্ছে বারবার। শেষবারের মতোন বড়ো ভাই শেখ জয়েন উদ্দিনের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লাম সবাই। আমরা চলে গেলাম বোর্ডি-এ। একটু সামনে ঝুঁকে হাঁটছিলাম কিনা জানি না। আমার হাতের ব্যাগটা একটু পরখ করে দেখলেন লাগেজ চেকিং অফিসার। হাতে নিয়ে ওজন আন্দাজ করে ছেড়ে দিলেন শেষে। বোর্ডিং পাস নিয়ে চলে গেলাম প্লেনে। আমার মোবাইলে তখনও নেটওয়ার্ক আছে। রাত তখন প্রায় পাঁচটা। শেষবারের মতোন ফোন করলাম বড়ো ভাইয়ের কাছে। কথার মাঝে কখন যে চোখ ভিজে গেছে বুঝলাম না। ভাই বললেন- এখন আর বাসায় যাবার সুযোগ নেই তার। আজ রাত থেকে যাবেন এয়ারপোর্টের ভেতরে, সকাল হলে ফিরবেন বাসায়। আল্লাহর কাছে দোয়া কামনা করে খোদা হাফেজ বলে ফোন রাখলেন তিনি। শুরু হলো ভিন্ দেশে বসবাসের উদ্দেশ্যে আকাশপথে আমাদের প্রথম যাত্রা।

সারাদিনের ক্লান্তি আর স্বজন ছেড়ে আসার বেদনায় সবার মন বিষন্ন। ঢুলুঢলু চোখে সিট বেল্ট বেঁধে বসে আছি সবাই। প্লেনের চাকা সচল হলো। এয়ার হোস্টেজদের সতর্ক চোখ। মধ্যপ্রাচ্যগামী শ্রমিকশ্রেণির যাত্রীদের সিট বেল্ট বাঁধাতে বেশ ক'বার ঘুরে দেখতে হলো তাদের। কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইট দেশের মাটি ছেড়ে উড়াল দিলো দোহার উদ্দেশ্যে। একটু পরেই ঘুমিয়ে গেলো ছোট্ট মেয়েটি এবং তারপর ছেলে। স্বামী-স্ত্রী দুজন পরস্পরের দিকে নির্বাক চেয়ে রইলাম কতোক্ষণ। দুজনের মনেই স্বজন ছেড়ে আসার গভীর বেদনা। কোনো কথা না বলে এভাবেই কেটে গেলো বেশ সময়। এরমধ্যে খাবার দিয়ে গেলো এয়ার হোস্টেজরা। কিছু মুখে তুলে চা চাইলাম। আমার স্ত্রী কিছু খেতে পারলো না। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানি না। দোহার কাছাকাছি আসতেই ঘুম ভেঙে গেলো। লোকাল টাইম সকাল ৬.৪৫টা। নামতে হবে দোহায়। ১.৩০ ঘন্টার মধ্যেই ধরতে হবে হিথ্রোগামী কানেকটিং ফ্লাইট।